
আগেও একবার এসেছিলাম এখানে। পুরনো অনুভূতিই নতুন করে ঝালাই হলো। তবে এবার আগেরবারের মতো আমার মতো করে সময় করতে পারিনি।
ছেঁড়া দ্বীপে আসলেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। মনে হয় ভূখন্ডের শেষ স্থলভাগে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর শুধু পানি আর পানি, দিগন্তসীমা পর্যন্ত কিংবা দিগন্ত ছাড়িয়ে! আর এক কদম এগুলেই হারিয়ে যাবো অসীম জলরাশির অতলে। ভাবতেই শিরদাড়া দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু আমি দিব্যি বেঁচে আছি। আর আমার পায়ের নিচে যে প্রবাল, এ রকম কোটি কোটি প্রবাল কীটের শত সহস্র বছরের আত্মত্যাগে গড়ে উঠেছে এই দ্বীপ। জীবন ও মৃত্যু কত কাছাকাছি!
গুগল ম্যাপে দেখলাম সেন্টমার্টিনের ভাসমান মূল ভূখন্ডের চেয়েও আরো বড় একটা অংশ সমুদ্রের নিচে রয়েছে। হয়তো শত বছর পর প্রবালের উপর প্রবাল জমে জেগে উঠবে নতুন ভূখন্ড। পাখিরা আসবে সেখানে। দানা ফেলবে। গজাবে নতুন গাছপালা। তারপর সভ্যতা গড়ে উঠবে। হয়তো এভাবেই একদিন গড়ে উঠেছিল আজকের সেন্টমার্টিন।
ছেঁড়াদ্বীপ থেকে ফিরছি। বড় আপার ফোন এলো। আমি নাকি চাচা হয়েছি, এই প্রথম। ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর খবর পেলাম আমার সহপাঠী সুমন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। চমেকে আইসিউতে ভর্তি আছে। ডাক্তার নাকি ফাইনালি আশা ছেড়ে দিয়েছে। এইসব পরিস্থিতি কিভাবে সামলাতে হয়, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। জীবন ও মৃত্যু এতো পাশাপাশি কেন?
“প্রবাল দ্বীপের গোড়াপত্তন হবে,
কি করে সে কথা হয়ে গেল জানাজানি!
দল বেঁধে এল অযুত প্রবাল কীট
কাঁপায়ে দু’পাশে দরিয়ার লোনা পানি।
রেখে এল তারা জীবনের সব সাধ,
ফেলে এল তারা জীবনের সব গান,
নব সৃষ্টির পথে চলে উন্মাদ;
ভিত্তিমূলেই জীবন করিতে দান।
অযুত, লক্ষ, কোটি প্রবালের দেহে,
শত যুগ ধরি’ সেই দ্বীপ গড়ে ওঠে,
কোটি প্রবালের তনুতে না হয় যদি
আরো বহু কোটি প্রবাল কীটেরা জোটে।
কবে দূরচারী পথিক পাখিরা এসে
কাকলি-মুখর সে দ্বীপে বাঁধবে ঘর,
জাগবে কখন প্রবাল দ্বীপের বুকে
নারিকেল শাঁখে স্বপ্নের মর্মর।
প্রবাল কীটেরা জানে না সে কথা, তবু
দল বেঁধে তারা করে গোড়াপত্তন।
বৎসর কাটে… শতাব্দী কেটে যায়…
তবু কোন দিন হয় না তো উন্মন।
আকাশে, মাটিতে আসে বদলের পালা,
কত তারা নেভে, জ্বলে কত শশী রবি;
প্রবাল দ্বীপের কীটেরা ভিত্তি গড়ে
ধৈর্য্য ত্যাগের সহিষ্ণুতার ছবি।
রাখে না খবর, খোঁজ রাখে না তো কেউ,
কেউ কোনদিন সন্ধান নাহি করে,
প্রবাল কীটেরা নিভৃতে গড়ে দ্বীপ,
সকল আঁখির; সকলের অগোচরে।
প্রবাল দ্বীপের গোড়াপত্তন হবে
কী ক’রে পেয়েছে তা’রা সেই হাতছানি!
মৃত্যু যাদের ত্যাগের মহান ছবি
মওতেই তারা পায় যে জিন্দেগানী।”
দ্বীপ নির্মাণ | ফররুখ আহমেদ
কাব্যগ্রন্থ: কাফেলা (১৯৮০)